সাঁওতাল রমণীর উদ্দাম যৌবন উপভোগ করতে পুরুলিয়া চলুন
‘সাঁওতাল রমণীর উদ্দাম যৌবন’ উপভোগ করতে এই শীতে চার রাত্রি পাঁচ দিন পুরুলিয়া ঘুরে আসুন।অনেক তো সারাদিন শহুরে, ফেয়ার অ্যান্ড লাভ্লি মেখে বিয়ের যোগ্য হয়ে ওঠা ফর্সা বা হাল্কা স্কিন টোনের নারী দেখলেন, এবার শীতে কালোকুলো পেটাই চেহারার সাঁওতাল রমণী দেখে ডান হাত গরম করে আসুন, ৯৯৯০ টাকা(এসি) এবং ৮৮৮০ টাকা(নন-এসি), মাত্র।
যদি মোটামুটি ঘাড় উঁচু করে তাকাই, তবে দেখতে পাবো যে, উত্তর আধুনিক পৃথিবীতে ‘নেশন’ এর যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা মূলত উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের ‘নেশন’। কোনও ভূখণ্ডের মূল আদি বাসিন্দাদের সেই ধারনার সাথে খুব একটা যোগ তো থাকেই না, বরং তারা রাষ্ট্রের ঝামেলি হিসেবেই চিহ্নিত হয়। ক্ষেত্র বিশেষে আমরা রোজ রোজ দেখতে পাচ্ছি নানাবিধ মুনাফার লোভে এই তথাকথিত “নেশন” তার উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেইসব মানুষের প্রতি,। এই আক্রমণ নানামাত্রিক, কখনো কোম্পানি বা খনি স্থাপনের আশায় মধ্য ভারতের আদিবাসীদের জল জমি জঙ্গল কেড়ে নিতে চাইছে নেশান কখনো কোন বায়বীয় উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী দেশে চলছে Chittagong Hill Tract (CHT) বা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের উপর যে নিরবিচ্ছিন্ন আক্রমণ। এখানে এটা উল্লেখ না করলেই নয়, কিছুদিন আগেই চিনিকল সংক্রান্ত আখ চাষ ও তার জমি নিয়ে বচসায়, বাংলাদেশের রংপুরে সাঁওতাল মানুষজনের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছেন সে দেশের গণতান্ত্রিক সরকার। চোখের ঠুলি সরালেই দেখা যায় দেশ স্বাধীন হোক বা পরাধীন, প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রের সাথে সেই ভূখণ্ডের আদিবাসীদের সংঘাত কখনই থামেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাঁওতাল বিদ্রোহ পরীক্ষার খাতায় মুখস্ত নামাতে বাধ্য হলেও, স্বাধীন দেশের ক্ষমতার সঙ্গে আদিবাসীদের চিরস্থায়ী সংঘাতের কাহিনী ইতিহাস বই তো তো দূর, ফাঁকা ঘরে একলা উচ্চারণ করলেও যে কোনও মুহূর্তে নিজেকে শ্রীঘরে দেখতে হতে পারে। লিনিয়ার ভাবে বোঝাতে চাইছি, নানাভাবে এই নিপীড়নের গল্প চেপে দিতে সক্ষম হয় এই ‘নেশন’।
আমরা যারা তথাকথিত সভ্য শহরকেন্দ্রিক জনপদগুলোর উদাসীন অধিবাসী, এবং দেশ বা সমাজের কথা উঠলে যারা নিজেদের মেইন্সট্রিম ভাবতে ভালবাসি, মূলত একটা কঞ্জিউমার সমাজের সদস্য, তারা অদ্ভুতভাবে এক সুপিরিয়র অবস্থান থেকেই এই কালো মানুষগুলোকে প্রথম থেকে দেখে আসছি। ঠিক কিসের ভিত্তিতে এই বিষয়টি আমাদের সম্মিলিত অবচেতনে ঢুকে পড়লো তা আমি জানিনা। হতে পারে আমরা বেশি ভাল দেখতে মনে করি নিজেদের এবং আরও ভাল দেখাবার উপায় আছে, আমাদের সাধ্যমত স্বর্গ আছে আর যাদের তা নেই তাদের অন্তত স্যারিডন আছে। আমরা ট্রেনে বাসে সরকারকে আলতো খিস্তি করলেও সরকার আমাদের মেরে বাঁশে ঝুলিয়ে দেয়না বা আমাদের মা দিদি বান্ধবীদের তুলে নিয়ে গিয়ে সরকারি, রাজনৈতিক, এবং বিগ কর্পোরেট এর পয়সায় পুষ্ট ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী গনধর্ষণ করে না বলেও হয়তো। কারণ যাই হোক, আমাদের দেখার মধ্যে যে ওইসব “অপর”দের প্রতি হীনভাব থাকেই তা নিশ্চিত। এবং নিরবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় শোষণ বা বঞ্চনার পাশাপাশি জন্ম নেয় এক সাংস্কৃতিক ও জাতিগত শোষণ, ঘুরপথে, এবং ঘুরপথে বলেই তার দিকে বলিষ্ঠ তর্জনী ওঠেনা এই আমাদের তথাকথিত মেইন্সট্রিম সমাজটা থেকে, বরং বাহবা জোটে, হাততালি জোটে। হাতে গোনা কিছু মানুষের আশাব্যঞ্জক কিন্তু কম বিখ্যাত কাজকর্ম থাকলেও বাঙালি মনন চিন্তন মার্কেটে ল্যান্ড করে “অরণ্যের দিনরাত্রি”, কাগজে ও পরে সেলুলয়েডে।
সেই থেকে শুরু করে ও আরও অনেক বিখ্যাত কবি লেখকের লিখিত বা মুখে মুখে প্রচারিত কাহিনী থেকে আমরা আস্তে আস্তে শিখতে শুরু করি সাঁওতাল মেয়েদের দেখা মাত্রই “তুই” করে বলতে হয়। তাদের যেকোনো মুহূর্তে হাত ধরে টেনে ঝোপে ঝাড়ে শুইয়ে ফেলা যায় এবং প্রাথমিক বাধা দেবার পর যখন তারা বুঝতে পারে যে শহরের “মরদ”টা লাগালে তার জীবন ধন্য হয়ে যাবে তখন তারা সলজ্জ আলগা হয়ে পড়ে। মূলত তারা যৌন ভোগবস্তু হয়ে ওঠে। উক্ত উপন্যাস ও তার সিনেমাটির প্রবল অর্থকরী ও ক্রিটিকাল সাফল্য আরও আরও মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করে এই লাইনে আরও প্রোডাক্ট নামাতে। অর্থাৎ এই নয়া ট্রেন্ডটি যে সার্বিক খ্যাতি লাভ করে যার পিছনে হাত থেকে যায় বাঙ্গালীর চিরকালীন দুই মায়েস্ত্রোর, যাদের কোনো দিন ক্রিটিকালি দেখা সম্ভব, এটা ভাবতেই হয়তো বড় অংশের জনগণের একশো বছর লাগবে। এইভাবে বিশেষ কবি লেখকগোষ্ঠীর রচনায় বারবার উল্লেখ, সবিস্তার বর্ণনা এবং নানান কীর্তিকাহিনীর মধ্যে দিয়ে এই সাঁওতাল রমণী সম্ভোগ ও তার গল্প প্রায় ফ্যান্টাসির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যদিও এখানেও একটি গোলমাল থাকে। রাষ্ট্রের ঢঙেই ঢাকা দিয়ে দেওয়া হয় পাল্টা রেজিস্টান্স এর গল্প। ঠিক যেমন চাপা পড়ে গেছে শ্রদ্ধেয় দীপক মজুমদারের এক আদিবাসী মেয়েকে অশালীন ইঙ্গিতের বিরুদ্ধে তাকে মশাল দেখানোর গল্পটি। ফলত এভাবেই প্রতিষ্ঠিত, প্রতিষ্ঠাকামী সকল প্রকারের সাহিত্যকর্মীর কলমে সচেতন উঠে আসতে থাকে সাঁওতাল রমণীর শরীর। এবং তারপর সিনেমা মাধ্যমেও। উত্তরসুবর্ণযুগ বাংলা সিনেমা যখন প্রকটভাবে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ফাইটিং নাচগান সজ্জিত “বাণিজ্যিক” ও “আর্ট” ফিল্মে, তখনও এই দ্বিতীয়টিতে আমরা দেখতে পাবো আবার সেই ট্রেন্ড। সেই ফ্যান্টাসির এক্সটেন্ডেড ভারসান। কিন্তু আর তাতে আমরা সত্যজিতের মার্জিত সৃজন দেখবো না, বরং অর্ধশিক্ষিত মধ্যমেধার হাতে পড়ে দেখবো এক স্যাডিস্ট বিকৃতি, যাকে ‘চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে’ বলেও জাস্টিফাই করা যেত না।
ফলে যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই হোটেলের বিজ্ঞাপনী প্রচারে “সাঁওতাল রমণীর” শরীরের ব্যবহারিক প্রয়োগের গৌরচন্দ্রিকা হঠাৎ নতুন কিছু একেবারেই নয়। কালের স্রোতে দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ও বিবর্তন মাত্র। সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, কত সিনেমা, সিরিয়াল, টেলিফিল্ম, গল্পে, উপন্যাস জুড়ে থাকে শহুরে ইন্টেলেকচুয়াল জনতার আদিবাসী অঞ্চলে ঘুরতে যাওয়া, কালো মেয়ের দুদিনের প্রেমে পড়ে-শুয়ে তাকে অন্তঃসত্ত্বা করে বা না করে শহরে ফিরে আসা, এবং “ মরদ” একদিন ঠিক ফিরে আসবে মনে করে সেই মেয়ের বিরহে দিন কাটানো। আগে তবু ভাষা, পোশাকআসাক বা মেকআপটুকু বাস্তবের কাছাকাছি রাখা হতো, এখনকার বাহামনি ইত্যাদিরা তো শহরের র্যাম্প থেকে উঠে গিয়ে ডাইরেক্ট আদিবাসী গ্রামে লাফিয়ে পড়েন, থুতনিতে তিনতে কালো পুটকি ও জবড়জং সাজসজ্জা করে ঘুরে ও উড়ে বেড়ান। সর্বোপরি, লড়াইয়ের মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলেও তাদের শহরের আচার আচরণ কথা বলার ধরন শিখে নিয়ে রীতিমত জাতে “উঠতে” হয়।
কেউ চিৎকার করে না, কেউ বলে ওঠেনা “ গাম্বাটের বাচ্চা বন্ধ কর”। সাঁওতাল রমণীর শরীরের অলিগলি নিয়ে পদ্য গদ্য লিখছেন, হোটেলের বিজ্ঞাপনের পণ্য বানাচ্ছেন, সেই চাবুক শরীরগঠনের কারণ যে অমানুষী শ্রম তাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করবেন কবে? ঘর গেরস্থালীর কাজ ছাড়াও তাঁদের পুরুষের সাথেই অংশগ্রহণ করতে হয় চাষবাসেও। বীজ বপন করার নির্দিষ্ট ভঙ্গি(“বিছন দেওয়া”) যা আয়ত্ত করতে হয়, চাষের মাঠে, ইটের ভাটায় আরও যেসমস্ত ছোটখাটো ডিটেল থাকে স্কিল থাকে সেসব ও অকথিত থাকে এই “দিস্তে দিস্তে লেখায়। রামকিঙ্করের সাঁওতাল পরিবার কাজটি ব্যতিক্রম এবং কেউ কেউ রুপচাক্ষিক, সকলেই নয় তার প্রমান। পেট করে চলে যাওয়া শহুরে “বাবুর” জন্য অপেক্ষা করা ছাড়াও, একে অপরের কোমরে হাত রেখে দল বেঁধে নাচ গান ছাড়াও ঘরে বাইরে যে অপরিসীম লড়াই করে তাঁদের চলতে হয় সেইসব আর কবে বলবেন বাবুগণ? আপনাদের মূলধারা কবে এইসব ছেড়ে বলে উঠতে পারবে কনকলতা মুর্মুর কথা? যে এইট ক্লাস ফেল রমণী শহুরে মরদকে বিয়ে করে শহরে এসে কলেজে পড়ে যোগ্য হয়ে ওঠে না। বরং প্রতিবাদ করার অপরাধে প্রথমে স্বামীর হাতে মার খেয়েও পরে আবার স্থানীয় মানুষজনের সমর্থনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। যে হুমকির উত্তরে রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টা হুমকি দিতে জানে এমনকি পরের নির্বাচনে সেই নেতাকে হেরে যেতে হয়। যে অধিকার বলতে জানে সকল মানুষের অধিকার, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইজম বা টার্মিনোলজিতে ভেঙে যাওয়া গোষ্ঠীর অধিকার ও শুধু নয়। কবে বলবেন সোনি সোরিদের কথা আপনাদের মহান সব শিল্পকর্মে? কবে সেইসব শিল্পকর্ম অডিটোরিয়াম থেকে মাঠ পাথারে বেরিয়ে আসবে? আসল সব লড়াই চেপে গিয়ে শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসৃত কাল্পনিক বাহামনিদের লড়াই নিয়ে আহাউহু করা আর লালসার ফ্যান্টাসি পালন করা ছাড়া আপনাদের যে আর কিছুই করার নেই তা আমরা শেষ কয়েক দশক থেকেই জানি।
তাই যান বাবুরা বরং পুরুলিয়া ঘুরে আসুন, সাঁওতাল রমণীর উদ্দাম যৌবনের ছেঁকায় গরম হয়ে আসুন। তার আগে গোটা পৃথিবী জুড়ে নানা লড়াইয়ে আদিবাসী নারীদের লড়াইয়ের কাহিনী পড়ে নিয়ে যান। সান্ধ্য আড্ডায়, ফেসবুকে যারা নারীবাদ সমর্থনের পাঁয়তারা করে নানান চুলকানি উস্কানো ভেড়ুয়ারা জেনে রাখুন এই দেশের সবচেয়ে বড় মহিলা সংগঠন আদিবাসী মহিলাদের, পুরনো হিসেবে নব্বই হাজার থেকে এক লাখ সদস্যের। যাদের নিষিদ্ধ করা আছে আইনে, যাদের সমর্থন করেন জানলেও আপনার জেল জরিমানা হয়ে যেতে পারে। আপনার টাকা, আপনার শিক্ষা, আপনার মূল্যবোধ। আপনি কোথায় যাবেন কাকে তুই ডাকবেন তা অন্য কেউ শিখিয়ে দিতে পারবে না। তবু চিৎকার করে যেতে হবে কাউকে না কাউকে। যদি একটা কানেও গিয়ে পৌছয়, সেখানে তিল পরিমাণ উপলব্ধিও জন্ম দিতে পারে কারোর চেতনায়, তবে এই আপাত অক্ষম চিৎকারও কিঞ্চিত সাফল্যলাভ করবে, আর সেইটুকু আশায় ভর করে আরও আরও সময় মাস দিন বছর ধরে চিৎকার করা যাবে, প্রশ্ন করা যাবে সমস্ত চলে আসা অবমাননাকর প্র্যাকটিস এবং ভণ্ডামির চোখে চোখ রেখে।